Header Ads

বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ গাজীপুর জেলা শাখা

ভাওয়াল রাজপরিবারের উত্থান



মোঃ শহিদুল হক

ইন্টারনেট , আনন্দবাজার পত্রিকা ও  বিভিন্ন সাময়িকী, বই থেকে তথ্য সংরক্ষিত
 

অত্যন্ত দূরদর্শী ও ধীমান বাংলার দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খানের মাধ্যমে দশসালা আইন প্রবর্তনের ভেতর দিয়ে ১৭২২ সালে এ দেশে জমিদারি প্রথার সূচনা হয়। ১৭৬২-৭২ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি জমা বন্দোবস্ত ও ১৭৭৭ সাল থেকে বার্ষিক মেয়াদি জমিদারির বন্দোবস্ত প্রথা চালু হয়। পরবর্তীতে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক স্থায়ী জমিদারি বন্দোবস্তের সূচনা হয়। ঐতিহসিকদের মতে,স্থায়ী বন্দোবস্তের পরবর্তী সময়ে গোটা বাংলায় সে সময়ে ১২১ টি জমিদারি ছিল, যার মধ্যে ভাওয়াল পরগণা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। স্থায়ী বন্দোবস্তের কাল থেকেই বৃটিশ সরকার লোক নারায়ণ রায়কে ভাওয়াল পরগণায় স্থায়ী জমিদার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তাঁর হাত দিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পায় ভাওয়াল পরগণার রাজবাড়ি।
সূদুর অতীতে সেন বংশ পূর্ব বঙ্গ সহ ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল প্রায় ১২০বছর রাজত্ব করেন। পূর্বে ব্রষ্মপুত্র, উত্তরে আড়িয়াল খাঁ, ও দক্ষীণ- পশ্চিমে শীতলক্ষা নদী পর্যন্ত সেনদের আধিপত্য ছিল। ধর্তব্য যে, সেন  বংশের পতনের পরও সেন বংশের সেনাপতি প্রতাপ রায় ও প্রসন্ন রায় আপন সাহস ও শক্তি বলে কিছুকালের জন্য রাজ বাড়িতে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁদের পতনের পর ভাওয়াল পরগণা বার ভুঁইয়ার অন্যতম ফজল গাজীর অধীনে চলে আসে। ফজল গাজীর পর দৌলত গাজীর ভাওয়ালের ভাগ্যকর্তা হিসেবে অভিষেক ঘটে। কিন্তু রাজ্যের সীমা নিয়ে দৌলত গাজীর সঙ্গে সে সময়ের ঢাকার নবাব নাজিমের বাদানুবাদ হয়। ফলশ্রুতিতে দৌলত গাজী ভাওয়াল পরগণা রক্ষার জন্য মুর্শিদাবাদ কোর্টে মামলা দায়ের করেন। সে সময়ে মুর্শিদাবাদ কোর্টে কুশধ্বজ নামে জনৈক মোক্তার মামলা পরিচালনায় প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। কুশধ্বজের খ্যাতি সম্বন্ধে সম্যক ধারনা পেয়ে দৌলত গাজী মামলা পরিচালনার ভার তার হাতেই ন্যাস্ত করেন। কুশধ্বজের
আপন মেধা মনিষা ও দক্ষতার বদৌলতে দৌলত গাজী এ মামলায় জয়ী হন।  মামলা পরিচালনা ও আইন বিষয়ে কুশধ্বজের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে দৌলত গাজী তাকে জয়দেবপুরের চান্দনাগ্রামে একটি বাড়ি ও কিছু জমি প্রদান করেন এবং পরবর্তিতে তাকে দেওয়ান হিসেবে নিয়োগ দান করেন। শুধু তাই নয়, কুশধ্বজের সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে দৌলত গাজী তাকে রায় চেীধুরীউপাধিতে ভুষিত করেন। কুশধ্বজের মৃত্যুর পর তার পুত্র বলরাম রায় দেওয়ানী পদে নিযুক্ত হন। ইতোমধ্যে ১৭৩৬ সালে দৌলত গাজী মক্কা হতে পবিত্র হজ্জব্রত পালন শেষে পায়ে হেঁটে ফেরার পথে পথি মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়। দৌলত গাজীর অবর্তমানে সুচতুর বলরাম রায় ও তার সহযোগীদের ষড়যন্ত্রে খাজনা বাকি পরলে মুর্শিদাবাদের নবাব গাজীর উপর রুষ্ট হন। বলরাম রায় আপন কুটবুদ্ধিতে দৌলত গাজীর প্রধান প্রধান কর্মচারীর সহযোগিতায় জমিদারি নিলামে তুলে নিজেদের নামেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লিখিয়ে নেন। বলরাম রায় কর্তৃক জমিদারি নিলামে নেওয়ার পর দৌলত গাজীর দৌহিত্র সুলতান গাজী ভারতের তৎকালীন গভর্ণর লর্ড কর্ণওয়ালিশের কাছে জমিদারি ফিরে পাওয়ার আবেদন করেও ব্যর্থ হওয়ার পর হতেই ভাওয়ালে গাজী বংশের শাসনামল শেষ হয়। ১৭৩৬ সাল পর্যন্ত গাজীরা ভাওয়াল পরগণার ভাগ্যকর্তা ছিলেন। ইতিহাস বিশ্রুত,গাজীদের নামানুসারেই এতদ অঞ্চলের নাম হয় গাজীপুর। এরপর ১৭৩৮ সাল হতে সুচতুর বলরাম রায়ের হাত ধরেই ভাওয়ালে হিন্দু জমিদারদের রাজত্ব শুরু হয়। বলরাম রায়ই ভাওয়াল রাজবংশের প্রথম পুরুষ। তিনি ভাওয়ালের রাজধানী চৌরায় বসবাস শুরু করেন। রাজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে পরবর্তিতে তার পুত্র শ্রীকৃষ্ণ রায় চান্দনা গ্রামের পূর্বদিকে পাড়াবাড়ি নামক স্থানে চৌরা হতে চলে আসেন। এই পাড়াবাড়িকেই পরবর্তী সময়ে শ্রীকৃষ্ণ রায়ের পুত্র কুমার জয়দেবের নামানুসারে জয়দেবপুর নামকরণ করা হয়। ১৭৮৭ ও ১৭৮৯ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর রাজবাড়িতে পাকা ইমারত
নির্মানের পাশাপাশি রাজউদ্যান ও রাজ শশ্মান বিনির্মানে লোক নারায়ণ রায় হাত দেন। সে সূত্রে লোকনারায়ণ রায়ই ভাওয়াল রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। ভাওয়াল রাজপ্রাসাদ থেকে বেশ খানিকটা দূরে নোয়া গাঁও মৌজায় ১৯.০৭ এলাকা জুড়ে লোক নারায়ণ রায় উপরোল্লেখিত রাজউদ্যানটি গড়ে তুলেন। সম্রাট নেবুচাঁদ যেমন তাঁর প্রিয়তমা সম্রাজ্ঞীর সন্তুষ্টি ও অবকাশ যাপনের জন্য বেবিলনের শূণ্য উদ্যান গড়ে তুলেছিলেন তেমনি লোক নারায়ণ রায় ও তাঁর প্রিয়তমা রাণীর জন্য নির্জন প্রান্তরে তিন কক্ষ বিশিষ্ট প্রমোদশালা উদ্যান তৈরী করেন। মিথ আছে, রাজ মহিয়সী  রাজবংশের ভবিষ্যত মঙ্গলের কথা ভেবে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে প্রমোদ ভবনের মেঝের অভ্যন্তরে বিশ কলস স্বর্ণমুদ্রা লুকিয়ে রাখেন। রাজউদ্যানের সৌন্দর্য বর্ধনে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান হতে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ আনা হয়েছিল। পরবর্তীতে রাজ উত্তরসূরীদের অবর্তমানে অপরিচর্যায় উদ্যানটি তার সৌন্দর্য হারাতে থাকে। উদ্যানের সংস্কার সংরক্ষণে স্থানীয় বুদ্ধিজীবী নুরুল ইসলাম ভাওয়াল রতœ সহ কেউ কেউ এগিয়ে এলেও প্রতœতত্ত্ব বিভাগের কেউ এ ব্যপারে সময়োপযোগী পদক্ষেপে এগিয়ে আসেননি। পরবর্তীতে দুষ্টগ্রহ কর্তৃক উদ্যানটি দখল হয়ে যায়। এমনকি উদ্যানের প্রমোদ ভবন দখল সহ বিরল প্রজাতির নানাবিধ বৃক্ষ সমূলে ধ্বংশ করে দেয়া হয়।
ভাওয়াল রাজ পরিবারের ২৩ পুরুষের মধ্যে ১৩ পুরুষ জমিদারি পরিচালনা করেন; এরমধ্যে ১১ তম জমিদার কালী নারায়ণ রায় প্রথম রাজা উপাধি গ্রহন করেন। এর আগে এদের নামের সঙ্গে শুধু রায় উপাধি ব্যবহার করা হতো।
ভাওয়াল জমিদারি সময়সীমা ১৯৩৮ থেকে জমিদারী আমলের শেষ দিন, অর্থাৎ ১৯৫২ পর্যন্ত। তৎকালিন সময়ে বাংলা বিহার উরিষ্যার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূমিজ আয়ের উৎস ছিল ভাওয়াল পরগণা। ১৯১৭ সালের ভূমি জরিপ ও রেকর্ড মূলে জানা যায় ভাওয়াল এস্টেটে সর্ব মোট মৌজার সংখ্যা ছিল ২২৩৪ টি, জমির পরিমাণ ছিল ৪৫৯১৬.৩০ একর, যার দুই- তৃতীয়াংশ ছিল বনভূমি; বার্ষিক রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ৮৩০৫২ টাকা। প্রজারা প্রত্যক্ষভাবে ৩৩ টি তহসিল অফিসের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করতো।
রাজধানীর উপকন্ঠে মাত্র বাইশ মাইল উত্তরে ভাওয়াল পরগনার অবস্থান। জয়দেবপুর রেল জংশনের অর্ধ কিলো পূর্ব দিকে অপূর্ব কারুকাজ সম্বলিত শিল্প ও নান্দনিকতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে তিনশষাট কক্ষ বিশিষ্ট বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ দোতলা এ রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় সরকারের প্রতœতত্ত বিভাগের উদাসিনতা সত্ত্বে ও এর প্রায় সব গুলো কক্ষ এখনো অক্ষত আছে। জমিদারিতে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ অযোগ্য গোলক নারায়ণের পুত্র কালী নারায়ণ রায় নান্দনিকতার অপূর্ব সৌকর্যে রাজ বাড়ির বাইরে সুবিশাল শক্তিশালী প্রাচীর সহ এ বাড়ির কাজ সম্পূর্ণ রুপে শেষ করেন ১৮৬০-১৮৬১ সালে। রাজবাড়ির সামনের অংশটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ধাঁচে নির্মিত। ছোট বড় দশ খানা বাড়ি ও পাঁচশত কক্ষ সহ রাজ বাড়ি এলাকার দৈর্ঘ্য ২৯৭ গজ ও প্রস্থ ১১০ গজ। রাজবাড়ির অভ্যন্তরে রয়েছে শ্রী শ্রী মানিক্যমাধবের দেব মন্দির। প্রতি বছর আষাঢ় মাসে এখনো জয়দেবপুরে এই দেবতার নামে রথ যাত্রা হয়। রাজবাড়ির গেট দিয়ে ঢুকেই সামনে পরবে বড় দালান। তাছাড়াও তখনকার রাজবাড়িতে জৌলুস ও আভিজাত্যের দম্ভ প্রকাশ ঘটিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাছারি বাড়ি,খাজাঞ্জিখানা,তোষাখানা,পিলখানা,আস্তাবল,নাটমন্দির,হাতিশালা,রাজউদ্যান ও রাজ স্মৃতিসৌধ ও স্নানাঘার সম্বলিত বিশাল বড় দিঘী। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় ও তাঁর পুত্র বিখ্যাত সন্ন্যাস রাজা রমেন্দ্র নারায়াণ রায় মিলে রাজ বাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলেছিলেন একটি চিড়িয়াখানা। যে বিষয়টি ভাওয়াল রাজাদের মননশীলতার পরিচয়কে সাবলীল ভাবে জানান দেয় সেটি হচ্ছে, রাজ বাড়ির একেকটি ভবনের কাব্যিক নামকরণ। রাজবাড়ির পশ্চিম অংশের দোতলা ভবনের নাম ছিলরাজ বিলাস’, নিচে রাজার বিশ্রামের কক্ষটির নাম ছিল হাওয়া  মহলমাঝের দক্ষিন দিকের খোলা খিলান যুক্ত কক্ষের নাম ছিল পদ্ম নাভি’,পশ্চিমের মাঝের ভবনের দোতলা ছিল রাণী মহলও রাজদিঘীর পশ্চিম তীরের ভবন ছিল খাস মহল’, এ খাস মহলেই থাকতেন রাজা কালী নারায়ণ রায় কর্তৃক নিয়োগকৃত ম্যানেজার বিখ্যাত সাহিত্যিক কালী প্রসন্ন ঘোষ, যিনি ব্যাপক দূর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের দায়ে রাণী বিলাস মণি কর্তৃক অপসারিত হয়েছিলেন। বর্তমান রাণী বিলাস মণি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ছিল ম্যানেজারের অফিস। রাজবাড়ির সামনের বর্তমান বিশাল মাঠটি তখনকার সময়ের। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে ১৯০৪ সালের দিকে রথখোলার পিলখানায় ভাওয়াল রাজার হাতি ছিল কুড়িটি। বর্তমান সার্কিট হাউস ও হাসপাতাল এলাকার টেকে টি গার্ডেন ম্যানেজার ট্রান্সচেরি দার্জিলিং থেকে চা গাছ এনে বিশাল আয়তনের চা বাগান গড়ে তুলেছিলেন। ভাওয়াল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হতো বসন্তে দোলযাত্রা ও বৈশাখে রাজ পূণ্যাহ। সেই পিলখানার হাতি, সেই সমৃদ্ধ চা বাগান, সেই রাজপূণ্যাহ এখন শুধু ধূসরতর স্মৃতির ক্যানভাস!
বর্তমানে ভাওয়াল রাজপ্রাসাদটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বিচার কার্য পরিচারনার কোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় শতাধিক সৈনিকের একটি ইউনিটের অবস্থান ও পরবর্তিতে ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে সেপ্টেম্বর মাসে ছত্রী সেনা ইউনিট কমান্ডিং অফিসার মেজর রউফ ও তার সহযোগীরা প্রাসাদ কক্ষের তালা ভেঙ্গে মূল্যবান সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়।
ভাওয়াল রাজ শশ্মান ঘাট
ভাওয়ালের জমিদার জয়দেব নারায়ণের দৌহিত্র লোক নারায়ণ রায় বাংলা ১২৫০ থেকে ১২৬০ সালের মধ্যে গড়ে তুলেন ভাওয়াল রাজ শশ্মান। বর্তমান জোড় পুকুর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে ভুরুলিয়া রাস্তার পাশে শান্ত সুনিবিড় নিসর্গের ভেতরে পাঁচ একর জমির  উপর গড়ে উঠে সমাধী সৌধ চত্বরটি। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে মূল শশ্মানের কাজে হাত দিয়েছিলেন রাজা কীর্তি নারায়ণ রায়। জানা যায় লোক নারায়ণ রায় ভারতের পুরী থেকে বিখ্যাত স্থপতি কামাক্ষ্যা রায়কে নিয়ে আসেন শশ্মানেশ্বরী নির্মানের জন্য। কামাক্ষ্যা রায় তাঁর মনের গহীনে একান্তে লালিত শিল্পি সত্ত্বার নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়ে শিল্প সুষমামন্ডিত ভাবে দৃষ্টি নন্দিত করে গড়ে তুলেন ছয়টি শিব মন্দির  বিশিষ্ট এ সমাধী সৌধটি। শশ্মানের পূর্ব পাশেই রয়েছে একটি সান বাঁধানো ঘাটের পুকুর, পুকুরের পাড়েই সমাধী ফলক; অনতিদূরে এক সময়ের প্রমত্তা চিলাই নদী, যেটি এখন নাব্যতা হারিয়ে সরু রেখায় পরিনত হয়েছে। চিলাই নদীর পাড়েই ভাওয়াল রাজাদের দাহ করে তাঁদের এক এক বংশধরদের স্মৃতি রক্ষার্তে এক একটি স্মৃতি সৌধ বা শিব মন্দির নির্মাণ করা হতো। ছয়টি শিব মন্দিরের মধ্যে মাঝেরটি সবচেয়ে উঁচু, পঞ্চ চূড়া বিশিষ্ট প্রায় সত্তুর আশি ফিটের মতো এর উচ্চতা। এক সময় এর চূড়া জয়দেবপুর শহরের অনেক জায়গা হতেই টাওয়ারের মতো দেখা যেতো। বর্তমানে আকাশ ছোঁয়া দালান কোঠা গড়ে উঠায় এটি আর দূর থেকে আগের মতো দেখা যায়না। মূল মন্দিরটি চৌকোনা বিশিষ্ট। জনশ্রুতি আছে, প্রথম সৌধটি সন্ন্যাস রাজার ঠাকুমা সত্যভামার স্মরণে, দ্বিতীয়টি রাজার পিসিমার স্মরণে, সবচেয়ে উঁচু মাঝের সৌধটি জমিদার কালি নারায়ণ রায়ের স্মরণে এবং ছয় নম্বর সৌধটি ভাওয়াল সন্ন্যাসী রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের বড় ভাই কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায়ের স্মরণে নির্মিত। শশ্মাণের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পরবে রণেন্দ্র নারায়ণ রায়ের স্মরণে নির্মিত শিব মন্দিরটি। মন্দিরের প্রধান দরজার ওপরে শ্বেত পাথরে খোদাই করে লেখা রয়েছে-
পূজ্যপাদ
স্বর্গীয় কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুরের পূণ্যস্মৃতি কল্পে তদীয় পত্নী শ্রীমতি সরযূ বালা দেবী কর্তৃক শ্রী শ্রী রণেশ্বর শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হইল। জন্ম ১২৮৯, ৪আশ্বিন/মৃত্যু১৩১৭,২৯ ভাদ্র।
কলকাতার বিখ্যাত স্থপতি প্রতিষ্ঠান জি পাল অ্যান্ড সন্স থেকে শ্বেত পাথরে খোদাই করা বড় কুমারের একটি আবক্ষ মূর্তি মন্দিরের ভেতরে পিছনের দেয়ালে রয়েছে।
ভাওয়াল রাজাদের উল্লেখযোগ্য অবদান
সমালোচনার পাশাপাশি শিক্ষা,শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ উন্নয়নে ভাওয়াল রাজ পরিবারের খ্যাতি সে সময়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের পিতা কালি নারায়ণ রায় কীর্তিমান পুরুষ ছিলেন। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে দাতা হাতেম তাইয়েরর মতো তিনি অর্থ দান করতেন, পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন কবি, লেখকচিন্তাবিদ থেকে শুরু করে সকল রকম শুভ বুদ্ধির পথিকৃতদের। কবি রাজকৃষ্ণ রায়কে মহাভারত অনুবাদের জন্য সে সময়ের ১২ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন, জয়দেবপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেনসমালোচনা সভানামে সাহিত্য সংগঠন। শুধু তাই নয়, ১২৮০ সালের দিকে তিনি কালোত্তির্ণ সাহিত্যিক কালী প্রসন্ন ঘোষকে এষ্টেটের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন নিজ উত্তারাধিকার ও দরিদ্র প্রজাদের উন্নয়নকল্পে(যদিও প্রসন্ন ঘোষ শুভ বুদ্ধির স¦াক্ষর রাখতে পারেননি, এমনকি ভাওয়ালের অহংকার স্বভাব কবি গোবিন্দ দাসকে ভিটে ছাড়া করেছিলেন তিনি)।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল নির্মান, রমেন্দ্র নারায়ণ দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা(বর্তমানে পৌরসভা ববন), মির্জাপুর পরমেন্দ্রনারায়ণ চ্যারিটেবল ডিসনেসারি প্রতিষ্ঠাজগন্নাত হল প্রতিষ্ঠা, পূর্ববঙ্গ স্বরস্বতি সমাজ প্রতিষ্ঠা,‘বান্ধবনামে মাসিক পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা,ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ভাওয়াল রাজ এষ্টেট বৃত্তি প্রদান সহ রাজপূণ্যাহ উৎসব ও তিতারকুল বারুণী মেলা ইত্যাদিতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতেন ভাওয়াল রাজবংশ। তাছাড়াও রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণের পতœী রাণী বিলাসমণির দানশীলা ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে খ্যাতি ছিল।  তিনি জয়দেবপুরে সাধারণ প্রজাদের জ্ঞানের আলোয় নিয়ে আসতে ১৯০৫ সালে রাণী বিলাসমণি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে অত্র প্রতিষ্ঠানের নামে ১০০ বিঘা জমি দান করেন।
পরিশেষ
ইউরোপ আমেরিকা যেখানে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে লালনের প্রশ্নে  হাজার হাজার বছর আগেকার পূরাকীর্তি ও স্থাপত্য সংরক্ষণে অতিমাত্রায় সজাগ, সেখানে আমাদের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর সম্পূর্ণরুপেই উদাসীন; এমনকি আমাদের রাষ্টযন্ত্রের প্রধান কর্তা ব্যক্তিগণ ও এসব অতি মূল্যবান সম্পদ রক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ। অযতœ অবহেলা আর বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকায় অংশগ্রহণ না থাকায় ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল রাজবাড়ি তার যৌবনকাল হারিয়ে বার্ধক্যে এসে উপনীত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সুপ্রাচীণ কালের শক্ত কাঠের সিঁড়ি খোয়া যেতে চলেছে, লোহার রেলিং ও গ্রীলের অবস্থা ও নাজুক, খসে পড়ছে অপূর্ব কারুকাজ খচিত দেয়াল। পানাম নগরী ও শিলাইদহ কুঠি বাড়ির মতো পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ও ইতিহাসবিদ ছাড়াই রাজবাড়ি ও শশ্মান সমাধী সৌধের যাচ্ছেতাই ভাবে সংস্কারের নামে নকশা পরিবর্তন, কক্ষ, সিঁড়ি ও দেয়াল পরিবর্তন করার ফরে ইতিহাস আশ্রিত কিংবদন্তীর ভাওয়াল রাজবাড়ির আসল চেহারার বিকৃতি ঘটছে। জেলা প্রশাসক ও প্রশাসনের অব্যবস্থাপনায়, এমনকি নীতি নির্ধারকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগ সাজশে আইনজীবি সমিতি ভবনের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে আইনজীবিদের জন্য ক্যান্টিন। শুধু তাই নয় ফিচারটি তৈরী
করতে ভাওয়াল রাজবাড়ির শশ্মানেশ্বরীতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে মন্দিরের পূরনো সৌধগুলো একে একে ভেঙ্গে পড়ছে; ছাদ, দেয়ালের অবস্থা ও অত্যন্ত করুণ; শশ্মানের অবকাঠামোর অবস্থা অনেকটাই বৃদ্ধ কোনো সম্রাটের নড়বড়ে দাঁতের মতো। ভেতরটা আদীকালের পাথুরে পাহাড়ের অন্ধকার গোহার মতো। ইতোমধ্যে দুটি মন্দিরের ভেতরে সাপ,চামচিকে ও ইঁদুর বসতি স্থাপন করেছে নির্ভয়ে। এদের পাশাপাশি মাদকাসক্তরা ও মন্দির দুটিকে অভয়াশ্রমের মতো ব্যবহার করছে। মেঝেতে পড়ে আছে সিরিঞ্জ, হেরোইন পেথিডিনের প্যাকেট, নারকেলের ছোবা ও সিগারেটের মোড়ক। ফলে আগত দর্শনার্থীরা কিংবদন্তীর সন্ন্যাস রাজার রাজবাড়ি ও অন্যান্য ইতিহাস আশ্রিত ঐতিহ্যবাহি স্থান গুলো দেখে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন; কেউ কেউ আশাহতের ন্যায় দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর ও রাষ্ট্রীয় কর্তা ব্যক্তিদের উদ্দেশে- সরকারি অফিস আদালত কি আর কোথাও করা যেতোনা? ঐতিহাসিক এই রাজবাড়িটি রক্ষায় ও সঠিক তত্ত্বাবধানে কবে নাগাদ এগিয়ে আসবে সচেতন
শতবর্ষের নানা ঐতিহ্যে লালিত এক সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক জনপদ (ভাওয়াল), বর্তমান গাজীপুর জেলা যার মধ্যে রয়েছে এক সমৃদ্ধ অতীত। আজ হতে দুই হাজার দুই শত পঞ্চাশ বছর পূর্বে এই জেলায় মৌর্য সম্রাট অশোকের শাসন কার্যকরী ছিল। তার প্রমাণ সাকাশ্বন স্তম্ভ। প্রাচীন পাল, দাস, চেদী, চন্ডালদের দ্বারা শাসিত হয়। জনপদগুলো ক্রমধারায় মুসলিম সময়ে ভাহওয়াল (ভাওয়াল) নামে সুবৃহৎ পরগণায় পরিণত হয়। মধ্য যুগে ভাওয়াল ছাড়াও জেলাতে তালিবপাবাদ, সেলিম প্রতাপ, চাঁদ প্রতাপ কাশিমপুর পরগণার সৃষ্টি হয়।
ইতিহাসের আলোকে জানা যায়, খ্রি: নবম শতাব্দীর দিক যশোপাল, শিশুপাল, প্রতাপ ও মহেন্দ্র ভাওয়ালের বিভিন্ন স্থানে স্থানে স্থাপন করেছিলেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ্য। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো পরিচিত ছিল চেদী রাজ্য নামে। বর্তমানের শ্রীপুর, কালিয়াকৈর (আংশিক) কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ, টঙ্গীসহ ময়মনসিংহ জেলার গফরঁগাও ও ত্রিশাল উপজেলার অংশ বিশেষ, ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার অংশ বিশেষ, নারায়ণগঞ্জ জেলার রুপগঞ্জ উপজেলার উওরাংশ, টঙ্গীর পশ্চিমে হরিরামপুর ইউনিয়ন নিয়ে এই সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেদী রাজ্যগুলো বিদ্যমান ছিল।
ভাওয়াল গবেষক নুরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্ন নামকরণ প্রসংগে বলেন চন্ডাল রাজাগণের পতনের পর ভাওয়াল গাজীদের অধিকার আসে। এই এলাকার স্বর্ণপ্রভ অতীত এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে মতান্তরের পরিমাণ যতটা কম, এর নাম করণের ব্যাপারে সংশয়াকীর্ণ মতদ্বৈতার পরিমান এতই অধিক যে, বর্তমান ভাওয়ালকে অনেকে ভদ্রপাল বা ভবপাল রাজ্য বলে অনুমান করে থাকেন। মহাভারতে বর্ণিত করুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় এই ভবপালরাজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। কারো কারো মতেভগালয়থেকে ভাওয়াল নামের উৎপত্তি। মহাভারতে ভগালয়নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রহ্মান্ড পুরানে ভদ্র নামে একটি বর্ণনা আছে। কেহ কেহ এরুপ ধারণা করেন যে, হয়ত এই নাম থেকেই ভাওয়াল নামের সৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু একনিষ্ঠ ইতিহাসের রহস্যভেদী বিচার বিশ্লেষণের কঠিন পরীক্ষায় এগুলি উত্তীর্ণ হতে পারে নি। এ অঞ্চলের নাম ভাওয়াল, এ কথা প্রথম পাওয়া যায় অইন-ই-আকবরীগ্রন্থে।
বিশ্লেষণ করলে দেখ যায়, ভাওয়াল নামের উৎপত্তি মহাভারতে বর্ণিত সেই ভদ্রপাল, ভবপাল কিংবা ভাগালয় হতে নয়। কারণ মাহভারতে বর্ণিত উল্লেখিত অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবেশ ও বর্ণিত অন্যান্য রাজ্যগুলো হতে দূরত্ব সমান নয়। আর মহাভারত লিপিবদ্ধের সময় ভাওয়ালে কি ধরণের সভ্যতা বিরাজ করছিল তা এখনো উদ্ধার করা যায়নি, সকলি অনুমান নির্ভর। এ ছাড়ও মহাভারতে দশম অধ্যায়ের রাণী কৈকয়ী যখন অঙ্গ-বঙ্গ-মগধ- কলিঙ্গের কথা বলেন অথবা বলেন কামরুপ- কামাখ্যার কথা, প্রশ্ন হচ্ছে, তখন তিনি কেন ভগালয় কিংবা ভদ্রপাল রাজ্যের কথা বলেন না? ভৌগোলিকভাবে বঙ্গ, মগধ ও কামরুপের মাঝখাণেই তো রয়েছে ভাওয়ালের অবস্থান। তবু বলেন নি, কারণ ভদ্রপাল বা ভগালয় কখনোই বর্তমানের ভাওয়াল জনপদ ছিল ন। থাকলে অবশ্যই উল্লেখ করতেন। অন্যত্র ভগালয় বা ভদ্রপাল রাজ্যের কথা বলা হয়েছে, তা তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যত্র অবস্থিত ছিল বলে মনে হয়। তবে এ কথা বলা যায় পূর্বে এ অঞ্চল প্রাচীন আমলের বঙ্গের নামেই পরিচিত লাভ করেছিল।
ঢাকার ইতিহাসগ্রন্থে যতীন্দ্র মোহন রায় বলেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় ভদ্রপাল, ভবপাল রাজ্যের কুরুকুলপতি দুর্য্যোধানের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন বর্তমান ভাওয়ালকে তাই অনেকেই ভদ্রপাল বা ভবপাল রাজ্য বলে অনুমান করে থাকেন। আসলে অনুমান আর সত্য এক নয়। শ্রী রায় কমল সেন রচিত অভিধানের ভুমিকায় বলা হয়েছে, মহাভারতে বর্ণিত ভগদন্ডের রাজধানী ছিল ভগালয় নামক স্থানে। আর ভগালয় থেকেই আজকের ভাওয়াল নামের উৎপত্তি। অনেকের মতে এই ব্রহ্মান্ডপুরাণে যে ভদ্রদেশের নাম দেখা যায় তা ছিল ভাওয়াল বলে বিখ্যাত এলাকারই নামপ্রচীন বাংলার মানচিত্রে ভদ্র প্রদেশ বলে কোন স্থান নেই। বিখ্যাত রামায়ণের অযোধ্যাকান্ডের দশম স্বর্গে বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া গেলেও গোটা রামায়ণের কোথাও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুস্পষ্ট কোর তথ্য পাওয়া যায় না এবং একই হয়তো মহাভাবতের ক্ষেত্রেও প্রয়োজ্য। মহাভারতের সভাপর্বে সে সময়ে ও অঞ্চলের যে সীমারেখা আকা হয়েছে, তাতে আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের কোন অস্থিত্ব খুজে পাওয়া যায় না।
ইসলামী বিশ্বকোষ, ডি ডি সেন, যতিন্দ্র মোহন, সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর, জেমস টেলর, আহম্মদ দানী এবং অধ্যাপক নলিনী কান্ত ভট্টাশালীর মতে, দ্বাদশ শতাব্দীতে এই ভাওয়াল জনপদের উপর সেনবংশীয় রাজাদের শাসন ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী সেন বংশীয় রাজা লক্ষন সেনকে পরাজিত করে বাংলাদেশ দখল করেন অনেকটা নাটকীয়ভাবে এবং বিনাযুদ্ধেই। ফলে মুসলিম শক্তির উৎখান ঘটে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে এখানে ভাহওয়াল (ভাওয়াল) গাজীও শক্তিশালী হয়ে উঠেন। তিনি একে একে দখল করে নেন এখানকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো। এর পরই এই জনপদের নাম নিজের নামানুসারে রাখলেন ভাওয়াল। মূল নাম ভাহওয়াল (ভাওয়াল) গাজী। তা থেকে ভাওয়াল গাজী। তাই ভাওয়াল নামের উৎপত্তি গাজী বংশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভাহওয়াল (ভাওয়াল) গাজীর নামানুসারে। ভাহওয়াল নাম পরে ধীরে ধীরে ভাওয়াল নামে পরিণত হয়। ভারত বর্ষের মহান শাসক শেরশাহ এর সময় ঢাকার উত্তরে চেদী রাজ্যগুলোতে ভাওয়াল গাজী(আরবী ভাহওয়াল গাজী-বাংলায় ভাওয়াল গাজী) জমীদারী লাভ করেন। শের শাহ ভাওয়াল গাজীর নামানুসারে পরগণার নামকরণ করেন ভাওয়াল (ভাহওয়াল পরগাণা) পরবর্তীতে আকবরের শাসনামলে উক্ত ভাওয়াল পরগণার শাসন বাহাদুর গাজীকে দেখতে পাওয়া যায়। ১৫৮০ সালে টোডরমল্ল বিহার ও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আর সেই জন্য, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সুবা বাংলাকে মোট চব্বিশটি সরকার ও সাতশত মহলে বিভক্ত করে যে বন্দোবস্ত করেন তা ইতিহাসে ওয়াসিল-তুমার-জুমা নামে সমধিক পরিচিত। উল্লেখ্য এই বিখ্যাত গ্রন্থেই প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ভাওয়াল বাজুহা নামের কথা। অথচ ভাওয়াল তখান ছিল সরকার বাজুহার অন্তর্গত একটি মহল বিশেষ ছাড়া অন্য কিছু নয় এবং যার বার্ষিক খাজনা ছিল ১৯.৩৫.১৬০ দম(৪০ দম বা দাম এক টাকা)। কয়েক বছর পর ১৫৯৫ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের দরবার থেকে প্রকাশিত হয় সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল রচিত আইন-ই- আকবরী নামক মহামূল্যবান গ্রন্থ যাতে ভাওয়াল বাজুহার উল্লেখ আছে একাধিকবার। পাহলোয়ান শাহ প্রথমে আস্তানা ফেলেন কালীগঞ্জে চৌরা গ্রামে। তখন কার চেদী রাজ্যগুলোতে ইসলামের বাণী প্রচার করেন এবং একই পথে কারফরমা শাহও ইসলাম প্রচার ও জমিদারী দিল্লী থেকে পরগণা করিয়ে আনেন। কালক্রমে তারই সুযোগ্য উত্তর পুরুষ শাসক ভাহওয়াল গাজী, দিল্লীর পাঠান সুলতানদের শাসনামলের শেষের দিকে চেদী রাজ্যগুলো দখল করে নিজ নামে ভাওয়াল পরগন্য হিসেবে কেন্দ্র হতে জমিদারীর আনেন। ভহওয়ালই পরের ভওয়াল নামে পরিচিতি পায়। ভাওয়াল পরগণায় স্থায়িত্ব কাল ছিল ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত।
মুঘলামলের আঙ্গিকে নবাবী বাদশাহী আমলে ভাওয়াল পরগণার রাজ্যস্ব আদায়ের জন্য ধীরাশ্রম (পৌরসভাধীন) একটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ভাওয়ালের রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত থানা ধীরাশ্রমকে ঘিরে বাদশাহী-নবাবী আমলে এক সমৃদ্ধ জনপদ পড়ে উঠেছিল, যার নিদর্শন ভগ্ন দালান দীঘি, প্রাচীন আমলের রাস্তা প্রভৃতি রাহাপাড়া, তেলীনগর, হায়দ্রাবাদ, রথখোলা, ভারারুল, মেঘডুবী প্রভৃতি গ্রামে দেখা যায়।

No comments

বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ. Powered by Blogger.