Header Ads

বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ গাজীপুর জেলা শাখা

ভাওয়াল সন্ন্যাসী

মোঃ শহিদুল হক
ইন্টারনেট , আনন্দবাজার পত্রিকা ও  বিভিন্ন সাময়িকী, বই থেকে তথ্য সংরক্ষিত
 
রমেন্দ্রনারায়ণ রায়

ভাওয়াল সন্ন্যাসী রাজার রোমাঞ্চকর কাহিনী রূপকথাকেও যেন হার মানায়। ভাওয়াল সন্ন্যাসী রাজার অলৌকিক প্রত্যাবর্তনের কাহিনী লোকগাঁথা হয়ে ফিরত বাংলার ঘরে ঘরে। ভাওয়াল পরগণার গাজীদের বীরত্বে জয়দেবপুরে রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অসহায় শিকার হয়েছিলেন এই বংশের মেজকুমার রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়। কথিত মৃত্যুর ১২ বছর পর তিনি সন্ন্যাসী বেশে ফিরে আসেন রাজবাড়ীতে। বৃটিশের আদালতে আর সংবাদপত্র জগতে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে যিনি ভাওয়াল সন্ন্যাসী নামে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিলেন।

ইতিহাস বলে ভাওয়ালের উৎপত্তি গাজী বংশের ভাওয়াল গাজী নাম থেকে তবে অনেকেই মতামত দিয়ে থাকেন প্রাচীনকালে ভবপাল বা ভদ্রপাল এই পরগণা শাসন করতেন তার নামানুসারে এই পরগণার নামকরণ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, মহাভারত যুগে যিনি ভগ বা ভগদত্ত নামে সুপরিচিত ছিলেন তার নামানুসারে ভাওয়াল নামটি এসেছে। অতীতে এই ভাওয়াল অঞ্চল সেনবংশীয় রাজাদের অধিকারভুক্ত ছিল। পূর্ববঙ্গের ভাওয়াল পরগণা বিস্তৃত ছিল ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার ৬০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে। সেন বংশের পতনের পর ভাওয়ালে বারভূঁইয়ার অন্যতম ফজল গাজী রাজ বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। এই গাজী বংশের একজন তার জমিদারী যে তিনজনের কাছে দান করে দেন তাদের একজন ছিলেন ব্রাক্ষণ,এই ব্রাক্ষণই ভাওয়াল বংশের প্রতিষ্ঠাতা, বাকি দুইজন কায়স্থ ছিলেন তারা বলধা ও পূবাইল নামক এলাকায় দুটি জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মোগল সম্রাট আকবরের ২৯ বছরের সুদীর্ঘ শাসনামলের পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রথম ৬ বছরের রাজত্বে এই বাংলার স্বাধীনতার প্রয়াসে মোঘল সেনাপতিদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যারা লড়েছিলেন ভাওয়াল পরগণার ফজল গাজী ও তার বংশধর বাহাদুর গাজী ছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম। গাজী বংশের প্রতাপ ছিল ঈর্ষনীয়, বর্তমান গাজীপুর নামটিও গাজী বংশের দেয়া। ইতিহাস বলে, ফজল গাজীর শাসনামলে ঈশা খাঁ ভাওয়াল পরগণার পার্শ্ববর্তী সোনারগাঁও রাজ্যের অধিপতি ছিলেন এবং মোঘল শক্তির বিরুদ্ধে তিনি যে জোট গঠন করেছিলেন তাতে ফজল গাজী যোগ দিয়েছিলেন। এগার সিন্ধুর যুদ্ধের পর ঈশা খাঁ বাদশাহ আকবরের অধীনতা স্বীকার করে নিলে গাজী বংশের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায় এবং নানাপ্রকার বিলাসব্যসনে তারা মগ্ন হন যা পরবর্তীতে তাদের ভয়াবহ পতনের আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল। বর্তমান জয়দেবপুর হতে ১৬ মাইল দূরে মাধবপুরে ফজল গাজী বাস করতেন এবং তিনিই মাধবপুরের নাম পরিবর্তন করে গাজীবাড়ি রাখেন। পরবর্তীতে দৌলত গাজী ঢাকার নবাবদের সাথে রাজ্যের সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ মামলায় কুশধ্বজ রায় নামক এক উকিলেরর সহায়তায় জয়ী হন। আর এই কুশধ্বজ রায় ভাওয়াল রাজাদের ইতিহাসে প্রথম পুরুষ। এক সময় দৌলত গাজী কুশধ্বজ রায়কে দেওয়ানী পদে নিযুক্ত করেন এবং জয়দেবপুরের নিকটস্থ চান্দনা গ্রামে একটি বাড়ি ও কিছু জমি দান করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর পুত্র বলরাম রায় বিভিন্ন চক্রান্তের শিকার হন। তার বড় অংকের খাজনা বাকি পড়ে যায় এবং এজন্য মুর্শিদাবাদের নবাব গাজীর ওপর রুষ্ঠ হন। উপায়ন্তর না পেয়ে বলরাম দৌলত গাজীর বিভিন্ন কর্মচারীর কাছে জমিদারী বিক্রয় করে দেন এবং কৌশলে পালসোনা ঘোষ বংশের নামে তিনি নিজেই দুই আনি জমিদারী ক্রয় করেন। এই জমিদারী পালসোনা বংশের জয়দেব রায় অধিকার লাভ করলে পীড়বাড়ি নাম পাল্টে বর্তমান জয়দেবপুর রাখেন। তারপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে এবং নানান উত্থানের মাধ্যমে গোলক নারায়ণের কাছে জমিদারী আসে। তার মা রাণী সিদ্দেশ্বরী দেবী অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার জোরে জমিদারী আগলে রাখলেও, মায়ের মৃত্যুর পর গোলক নারায়ণ জমিদারী পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন এবং নিজ পুত্র কালী নারায়ণের কাছে জমিদারীর ভার তুলে দেন। তিনিই বর্তমান রাজবাড়ি পাকা করেন, মাধব মন্দির স্থাপন করেন, রাজবাড়ির পশ্চিমে দীঘি খনন করেন এবং রাজবাড়ির দক্ষিণে একটি বাজার বসান। স্ত্রী লক্ষীপ্রিয়ার গর্ভে জন্মানো গোলক নারায়ণের সন্তান কালী নারায়ণ খ্যাত ছিলেন বিদ্যাশিক্ষায়, বাক্যালাপে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী। তিনি জয়দেবপুরে একটি বিদ্যালয় ও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে রাজেন্দ্রনারায়ণ নামে এক পুত্র সন্তান রেখে তিনি মারা যানতারই নামানুসারে বর্তমান রাজেন্দ্রপুর নামক এলাকাটি রয়েছে। তার স্ত্রী রানী বিলাসমণি ছিলেন অত্যন্ত গুণবতী এবং শিক্ষাণুরাগী। রাজা উপাধিতে ভূষিত রাজেন্দ্রনারায়ণ বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক কালী প্রসন্ন ঘোষ, বিদ্যাসাগর, সি-আই-ইকে ভাওয়ালের ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করেছিলেন এবং উল্লেখযোগ্য স্থানীয় উন্নয়ন করেছিলেন। ইতিহাসে বহুল আলোচিত ভাওয়ালে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য সমালোচনী সভা, পাশাপাশি রাজমাতা রাণী বিলাসমণির নামানুসারে উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ। রাণী বিলাসমণির তিন পুত্র সন্তান ছিলেন তন্মেধ্যে মধ্যম পুত্র রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়। তিনিই কিংবদন্তী, সন্ন্যাসী রাজা। মৃত্যুর প্রায় ১২ বছর পর তিনি রাজ বাড়িতে সন্ন্যাসী বেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং নিজেকে রাজা পরিচয় দিয়ে সিংহাসন দাবী করেন। ১৯০৯ সালে রাজা রামেন্দ্রনারায়ণ মারা গিয়েছিলেন বলে যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল তারপর থেকেই এই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। দীর্ঘ ১২ বছর পর তিনি সন্ন্যাসী বেশে যখন ফিরে এলেন এবং ১৯২১ সালের ৪ মে নিজেকে ভাওয়াল রাজা বলে ঘোষণা দিলেন তখন রাজ পরিবারের আন্তঃষড়যন্ত্রকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে, এমনকি ভাওয়াল সন্ন্যাসী রাজার স্ত্রী বিভাবতী পর্যন্ত তাকে স্বামী এবং ভাওয়াল রাজা বলে অস্বীকার করেন। ফলশ্রুতিতে কোর্টে ওঠে সেই ঐতিহাসিক ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলাটি।

রমেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের মেজ পুত্র। রাজমাতা, রাণী বিলাসমণি ছিলেন তেজস্বিনী ও দূরদর্শী সম্পন্না একজন মা। তিনি নিজে দরিদ্র ঘরের সন্তান ছিলেন। রাণীমাতা হিসেবে নিজ পরগণার প্রজাদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রজাগণের কাছে তিনি ছিলেন মাননীয়া, হিতৈষিণী। রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ ভোগ-বিলাসে এতটাই মত্ত ছিলেন যে স্বাভাাবিক রাজ্য পরিচালনা তো দূরে থাক নিজেকেই গুছিয়ে রাখতে পারতেন না। তাই রাজমাতা বিলাসমণিই প্রকৃত অর্থে জমিদারী দেখভাল করতেন। এস্টেটের ম্যানেজার বিখ্যাত সাহিত্যিক কালী প্রসন্ন ঘোষ নিজের বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধিতে এতটাই লোভী হয়ে পড়েন যে রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণকে নিজ স্বার্থে তিনি তাকে ভোগবাদের নোংরা দিকে ঠেলে দেন এবং এতে করে রাজকোষের অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। একে তো রাজা স্বাভাবিক জমিদারী করার মত অবস্থাতেও নেই তার ওপরে রাজকোষের এই দৈন্যদশা, রাজমাতা বিলাসমণি টের পেয়ে যান সব চক্রান্ত এবং নিজ সন্তানদের এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে একটাই উপায় খুঁজে বের করেন, শিক্ষার গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন এবং কুমারদের মিস্টার হোয়াটন নামক একজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। কিন্তু কুমারদের অবস্থা বিশেষ আশাব্যঞ্জক ছিল না। তিনি রাণীকে একবার চিঠিতে কুমারদের পড়াশোনা নিয়ে লিখেছিলেন, “আমার আশা ছিল যে, আপনার তিন পুত্রকে আমি কিছু শেখাতে পারব। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে তারা তাদের পড়াশোনা যতদূর সম্ভব অবহেলা করে। পড়াশোনা করবার তাদের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই এবং আমার কথা মোটেই শোনে না।এই ছিল কুমারদের অবস্থা। মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ ব্যতিক্রম ছিলেন না। হাতে জমিদারীর প্রচুর টাকা আসত, রাজা ও রাজমাতার কোন কথাই তারা কানে তুলত না। এরই মাঝে ১৯০১ সালে বাবা, রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয় এবং রাণী বিলাসমণি জমিদারী নিজ হাতে তুলে নেন। ১৯০২ সালে মেজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণের বিয়ে হয় অপূর্ব সুন্দরী বিভাবতীর সাথে। বিভাবতীর মা ফুলকুমারী দেবী উত্তর পাড়ার মুখুর্জ্যো বাড়ির নবকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা। ভাওয়াল রাজবাড়িতে বিভাবতী বিশেষ সুখী ছিলেন না কারণ স্বামী রমেন্দ্রনারায়ণ বরাবরই এলোকেশীকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এলোকেশী ঢাকা থেকে রাজবাড়িতে নাচতে এসেছিলো। এলোকেশীকে নজরে পড়ে গেলে মেজকুমার তাকে হাওয়া খানায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। মেজকুমারের উল্লেখযোগ্য কোন গুণাবলী ছিল না। তিনি শিকারে যেতেন, টমটম হাকাতেন। চেহারা রাজাদের মত হলে কী হবে চাল-চলন, পোশাক-আশাকে তাকে রাজ পরিবারের সদস্য বলে মনে হত না। অন্য দুই কুমারের মত বেহায়াপনার সাথে বাড়তি যা বলার ছিল তা হল মেজকুমার কুসিৎত ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। স্ত্রী বিভাবতীর সাথে তার স্বাভাবিক কোন সম্পর্কই ছিল না। ১৯০৭ সালে রাজমাতা রাণী বিলাসমণির মৃত্যু হলে ভাওয়াল রাজ পরিবারে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বীজবপন হয়। কুমাররা তখন বিলাস জীবনে গা ভাসিয়ে চলছেন। এসবের মাঝেই মেজকুমারের রোগ দেহে বাড়তে থাকলে সবাই বুঝতে পারেন ঢাকার চিকিৎসকরা রোগের নিদান দিতে পারছেন না, কলকাতায় যাওয়া চাই। রাজমাতার মৃত্যুর পরপরই ১৯০৮ সালে রাণী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাওয়াল রাজবাড়ীতে প্রবেশ করেন। শুরু হয় নাটকের অবতাড়না। সত্যেন্দ্র রাজবাড়ীতে এসেছিলেন শিলং এ ডেপুটির চাকুরি নেবেন বলে কিন্তু জমিদারী পরিচালনায় কুমারদের দুর্বলতা দেখে জেঁকে বসেন রাজবাড়ীতে। রাজবাড়ীতে রানী বিভাবতীর চেয়ে বেশি প্রতাপে চলতেন তিনি। মেজকুমারকে কলকাতায় চিকিৎসা করানোর জন্য যারা সাথে গিয়েছিলেন তাদের মাঝে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন যদিও তার মা তাকে জয়দেবপুর থেকে উত্তর পাড়ার বাড়িতে যেতেই তাগাদা দিয়েছিলেন। ছোট কুমার পরে যাবেন বলে রয়ে গেলেন তবে বড় কুমার ও তার স্ত্রী, মেজকুমার ও বিভাবতীর সাথে গিয়েছিলেন। কলকাতায় কদিন থাকার পরেই তারা জয়দেবপুরে ফিরে আসেন কারণ লর্ড কিচেনারসহ আরও দুইজন সাহেব শিকারে যাবেন। পরে অন্য দুই কুমারসহ তারা শিকারে গিয়েছিলেন। মেজকুমারের স্বাস্থ্য বিশেষ উন্নতি হয়নি বলে ঠিক করা হল বায়ু পরিবর্তনের জন্য দার্জিলিং যাওয়া হবে। ইতোমধ্যে স্ত্রী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রের সাথে মেজকুমারের বেশ সখ্য গড়ে উঠেছিল। দার্জিলিং যাবার আগের দিন রাতে রাজ পরিবারের ডাক্তার আশু ডাক্তারের পিতা মহিম বাবুর বাড়ীতে মেজকুমার নিমন্ত্রণ খেয়েছিলেন, এবং বেশ হাসিখুশি মুখেই তিনি দার্জিলিং-এ উদ্দেশ্যে রাজবাড়ি ছেড়েছিলেন। সত্যেন্দ্র এরই মাঝে দার্জিলিং গিয়ে থাকার জন্য স্টপ অ্যাসাইড নামক একটি বাড়ি ঠিক করে এসেছিলেন। ১৯০৯ সালের ১৮ এপ্রিল মেজকুমার, মেজরানী, তার ভাই সত্যেন্দ্র, আশুতোষ ডাক্তারসহ প্রায় বিশজনের দল নিয়ে দার্জিলিং এ রওনা হন এবং ২০ এপ্রিল এসে পৌছান। প্রায় পনের দিন বিলিয়ার্ড, তাস খেলে কাটালেন। হঠাৎ একজন খবর দিল টাইগার হিলে পাহাড়ী ভাল্লুক আছে, মেজ কুমার উৎসাহী হয়ে উঠলেন, তিনি শিকারে যাবেন। কিন্তু তিনি আর শিকারে যেতে পারলেন না। মে মাসের ৫ তারিখের দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।


রমেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের মেজো পুত্র। রাজমাতা, রানী বিলাসমণি ছিলেন তেজস্বিনী ও দূরদর্শীসম্পন্না একজন মা। রানীমাতা হিসেবে নিজ পরগনার প্রজাদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ ভোগ-বিলাসে এতটাই মত্ত ছিলেন, স্বাভাবিক রাজ্য পরিচালনা তো দূরে থাক নিজেকেই গুছিয়ে রাখতে পারতেন না। তাই রাজমাতা বিলাসমণিই প্রকৃত অর্থে জমিদারি দেখভাল করতেন। এস্টেটের ম্যানেজার বিখ্যাত সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন ঘোষ নিজের বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধিতে এতটাই লোভী হয়ে পড়েন যে, রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণকে নিজ স্বার্থে তিনি ভোগবাদের নোংরা দিকে ঠেলে দেন এবং এতে রাজকোষের অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। নিজ সন্তানদের এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে রাজমাতা একটাই উপায় খুঁজে বের করেন_ শিক্ষার গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেন এবং কুমারদের মিস্টার হোয়াটন নামক একজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। কিন্তু কুমারদের অবস্থা বিশেষ আশাব্যঞ্জক ছিল না। মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ ব্যতিক্রম ছিলেন না। হাতে জমিদারির প্রচুর টাকা আসত, রাজা ও রাজমাতার কোনো কথাই তারা কানে তুলত নাএরই মাঝে ১৯০১ সালে বাবা রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয় এবং রানী বিলাসমণি জমিদারি নিজ হাতে তুলে নেন। ১৯০২ সালে মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের বিয়ে হয় অপূর্ব সুন্দরী বিভাবতীর সঙ্গে। ভাওয়াল রাজবাড়িতে বিভাবতী তেমন সুখী ছিলেন না। মেজো কুমারের উল্লেখযোগ্য কোনো গুণাবলি ছিল না। তিনি শিকারে যেতেন, টমটম হাঁকাতেন। চেহারা রাজাদের মতো হলে কী হবে, চালচলন, পোশাক-আশাকে তাকে রাজপরিবারের সদস্য বলে মনে হতো না। অন্য দুই কুমারের মতো বেহায়াপনার সঙ্গে বাড়তি যা বলার ছিল তা হলো মেজো কুমার কুৎসিত ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন।
১৯০৭ সালে রাজমাতা রানী বিলাসমণির মৃত্যু হলে ভাওয়াল রাজপরিবারে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বীজ বপন হয়। মেজো কুমারের রোগ দেহে বাড়তে থাকলে সবাই বুঝতে পারেন ঢাকার চিকিৎসকরা রোগের নিদান দিতে পারছেন না, কলকাতায় যাওয়া চাই। রাজমাতার মৃত্যুর পর পরই ১৯০৮ সালে রানী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাওয়াল রাজবাড়িতে প্রবেশ করেন। সত্যেন্দ্র রাজবাড়িতে এসেছিলেন শিলং এ ডেপুটির চাকরি নেবেন বলে। কিন্তু জমিদারি পরিচালনায় কুমারদের দুর্বলতা দেখে জেঁকে বসেন রাজবাড়িতে। রাজবাড়িতে রানী বিভাবতীর চেয়ে বেশি প্রতাপে চলতেন তিনি। মেজো কুমারকে কলকাতায় চিকিৎসা করানোর জন্য যারা সঙ্গে গিয়েছিলেন তাদের মাঝে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন। যদিও তার মা তাকে জয়দেবপুর থেকে উত্তরপাড়ার বাড়িতে যেতেই তাগাদা দিয়েছিলেন। ছোট কুমার পরে যাবেন বলে রয়ে গেলেন। তবে বড় কুমার ও তার স্ত্রী, মেজো কুমার ও বিভাবতীর সঙ্গে গিয়েছিলেন১৯০৯ সালের ১৮ এপ্রিল মেজো কুমার, মেজো রানী, তার ভাই সত্যেন্দ্র, আশুতোষ ডাক্তারসহ প্রায় ২০ জনের দল নিয়ে দার্জিলিংয়ে রওনা হন এবং ২০ এপ্রিল এসে পেঁৗছান। মে মাসের ৫ তারিখের দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ অসুস্থ হয়ে পড়লে আশু ডাক্তার তাকে পেট ফাঁপার ওষুধ দিয়েছিলেন। তবে ৬ মে ১৯০৯ সালে রাত ৩টার দিকে মেজো কুমার আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। মেজো কুমারের অবস্থা দেখে আশু ডাক্তার সে রাতে আর ওষুধ দেননি বরং পর দিন সিভিল সার্জনের কাছে আরও ভালো চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করেন। স্ত্রী বিভাবতী যথাসম্ভব স্বামীর কাছে থাকতে চাইলেও তার ভাই সত্যেন্দ্র চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো মেজো কুমারকে আলাদা ঘরে রাখেন। সিভিল সার্জন এক ধরনের মিঙ্চার মেজো কুমারকে খেতে দিয়েছিলেন। মেজো কুমারের অবস্থা কখনো-সখনো ভালোর দিকে গেলেও আসলে খারাপের দিকেই এগোচ্ছিল। ৮ মে স্থানীয় ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের ডাক্তার ক্যালভার্ট মেজো কুমারের যন্ত্রণা দেখে মরফিয়া ইনজেকশন দিতে চাইলেন কিন্তু মেজো কুমার রাজি হননি। অবশ্য বিকালের দিকে মেজো কুমার ইনজেকশন নেন এবং এতে করে পেটের ব্যথা কমে যায়। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকবার বমি ও রক্তমিশ্রিত পায়খানা করার কারণে ভয়াবহ রকমের দুর্বল হয়ে পড়েন। মেজো কুমারের শারীরিক অবস্থা নিয়মিত দার্জিলিং থেকে টেলিগ্রাম করে জানানো হচ্ছিল। রানী বিভাবতীর মামা বিবি সরকার নামে একজন ডাক্তার নিয়ে এসে মেজো কুমারের অবস্থা দেখে যান। তখন মেজো কুমারের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়, গা শীতল হয়ে গেছে। ডাক্তার সরকার মেজো কুমারকে মৃত বলে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন বলে জানা গেলেও স্ত্রী বিভাবতী সেটা পরবর্তীতে অস্বীকার করেন। এখানে একটি রহস্যের সৃষ্টি হয়, মেজো কুমার কখন মারা গিয়েছিলেন? সন্ধ্যায় নাকি মাঝরাতে? স্টপ অ্যাসাইড বাড়ির দারোয়ানসহ অনেকেই বলেছেন, মেজো কুমার সন্ধ্যায় মারা গিয়েছিলেন অথচ মেজো রানী ও তার ভাই সত্যেন্দ্র সবসময় বলে এসেছেন মেজো কুমার মাঝরাতে মারা গিয়েছিলেন। সে যাই হোক, ১০ মে সকালে মেজো কুমারের মৃত্যুর খবর টেলিগ্রাম করে সবাই দার্জিলিং ত্যাগ করে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা করেন। ১১ মে মধ্যরাতে মেজো রানী জয়দেবপুরে ফিরে আসেন। রাজবাড়িতে শোকের ছায়া নেমে পড়ে। ১৮ মে মেজো কুমারের শ্রাদ্ধ করা হয়েছিল। এ সময় গুজব ছড়িয়ে গেল মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের মৃতদেহের শ্রাদ্ধ নাকি ঠিকভাবে করা হয়নি। কোনোমতে গুজব এড়িয়ে শ্রাদ্ধ করা হলেও গুজবটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে হিসাবের গোলমালে ভাওয়াল রাজ এস্টেটের ম্যানেজার সেনের চাকরি তখন যায় যায়, সত্যেন্দ্র তার বোনকে নিয়ে ম্যানেজার সেনের সঙ্গে পরামর্শ করে মিস্টার সেনের পরিবর্তে মিস্টার নিডহাম নামক এক নতুন ম্যানেজার নিয়োগ দিলে ষড়যন্ত্র আরও গভীরে ঠেকে। অবশ্য ষড়যন্ত্র ছাড়াই রাজবাড়ির কর্তৃত্ব নেওয়া হলো। কারণ তিন বছরের ব্যবধানে ছোটকুমার ও বড় কুমার মারা গেলে রাজবাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। রাজবাড়ির তিন রানীই ছিলেন সন্তানহীনা এবং তারা সবাই কলকাতায় পাড়ি জমান। ভাওয়াল রাজ এস্টেটের অবস্থা খুবই করুণ, রাজকোষে যা ছিল ষড়যন্ত্রকারীরা লুটে নিয়েছে। ভাওয়াল এস্টেটের অবস্থা যতই দুর্বল হচ্ছিল মেজো কুমার জীবিত আছেন এবং তিনি একদিন ফিরে আসবেন এ গুজব ততই শক্তিশালী হচ্ছিল। রাজবাড়ির ভেতরে মাধববাড়িতে একজন মৌনসন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। শুরু হয় নতুন উত্তেজনা। চারদিকে খবর রটে যায় ভাওয়াল রাজ মেজো কুমার ফিরে এসেছেন। জনসাধারণ, প্রজা, ভাওয়াল এস্টেটের কর্মচারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সন্ন্যাসীকে দেখতে। ১৯২১ সালে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধের কাছে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাবের বক্তব্য পাওয়া যায়। জটাচুল, ঘন দাড়ি, সারা গা ভস্মাচ্ছাদিত সন্ন্যাসীর সামনে ধুনি জ্বলছে। রাস্তার লোকেরা তাকে ফিরে ফিরে দেখে যেত। লোকেরা তার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলত। পরিচয় জানতে চাইলে সন্ন্যাসী বলতেন, আত্দপরিচয় দিতে গুরুর নিষেধ আছে। কেউ কেউ তখনই সন্ন্যাসীকে ভাওয়াল রাজা বলে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। অতুল বাবু সন্ন্যাসীকে রাজবাড়িতে নিয়ে আসেন। মাধববাড়িতে ছাইমাখা সন্ন্যাসীর আগমন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে প্রজাদের মাঝে নতুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ঢাকা থেকে বাঁধিয়ে আনা অন্য কুমারদের ছবিগুলো সন্ন্যাসীকে দেখতে দেওয়া হলে সন্ন্যাসী কাঁদতে আরম্ভ করেন। তার কান্না দেখে জ্যোতির্ময়ী দেবীও কেঁদে ফেলেন। পরে অষ্টমী স্নান উপলক্ষে সন্ন্যাসী ঢাকায় ফিরে যান। ৩০ এপ্রিল সন্ন্যাসী চন্দ্রনাথ আর সীতাকুণ্ড থেকে আবার জয়দেবপুরে রাজবাড়িতে ফিরে আসেন। তার দুদিন বাদে চিলাইখালে সন্ন্যাসী স্নান করতে গেলে জ্যোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীর গায়ে মেজো কুমারের বিশেষ দাগগুলো দেখতে পান। ইতোমধ্যে সন্ন্যাসীর আচরণ, কথন, চাহনি, গায়ের প্রকৃত রং, চেহারা ইত্যাদি মেজো কুমারের সঙ্গে বিশেষ মিল থাকায় সন্ন্যাসীকে কথিত মৃত মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ বলে যে সন্দেহ করা হয়েছিল, গায়ের কাটা দাগ ও কয়েকটি জন্মগত দাগ হুবহু মিলে যাওয়ায় জ্যোতির্ময়ী দেবী সরাসরি সন্ন্যাসীর পরিচয় প্রকাশ করতে ব্যাপক চাপ দেন। জ্যোতির্ময়ী দেবীর প্রশ্ন ভাওয়াল পরগনার হাজারো প্রজার মনের প্রশ্ন হয়ে সন্ন্যাসীর সামনে এসে দাঁড়ায়। রাজপরিবারের সদস্য এবং প্রজারা সন্ন্যাসীর উত্তরের জন্য রাজবাড়িতে ভিড় করে। সারা জয়দেবপুরে রটে যায় এ খবর। সেদিন সকালেই হাজারো প্রজার সামনে জ্যোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীকে বলেন, তোমার চেহারা আর শরীরের চিহ্নগুলো আমার মেজো ভাইয়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তুমিই আমার নিরুদ্দিষ্ট মেজো কুমার। তোমার পরিচয় প্রকাশ কর। উপস্থিত জনতা তখন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল সন্ন্যাসী কী জবাব দেন। কিন্তু সন্ন্যাসী তখনই কোনো জবাব দেননি। শেষ বিকালের দিকে জনতার কৌতূহলের অবসান ঘটিয়ে সন্ন্যাসী বলতে শুরু করেন_ আমার নাম রমেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী। উৎসুক জনতার মাঝ থেকে প্রশ্ন আসে তোমার মায়ের নাম কী? সন্ন্যাসী জবাব দেন, রানী বিলাসমণি। আবারও প্রশ্ন আসে আপনাকে যে মানুষ করেছিল সেই দাইয়ের নাম কী? মৃদু কম্পমান গলায় সন্ন্যাসী উত্তর করেন, অলকা। ধাত্রী মায়ের নাম বলেই সন্ন্যাসী অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ধাত্রী মায়ের নাম সঠিকভাবে উত্তর করার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত জনতা উলুধ্বনি ও জয়ধ্বনি করে ওঠে, রাজবাড়ি মুহুর্মুহু কেঁপে ওঠে সমবেত জনতার জয়ধ্বনিতে। প্রজারা বলাবলি করতে শুরু করে, তিনিই প্রকৃত মেজো কুমার, এস্টেট যদি তাকে কুমার বলে গ্রহণ না করে তবুও প্রজারা তাকে মেজো কুমার বলেই গ্রহণ করবে, তার সঙ্গে কুমারের মতোই আচরণ করবে। অনেকে তখনই কুমারকে নজরানা দিতে শুরু করে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংলিসম্যান কাগজে ৭ মে ঢাকা সেনসেশন শিরোনামে সন্ন্যাসী নিজেকে ভাওয়াল রাজা মেজো কুমার বলে দাবি করেছেন বলে খবরটি প্রচার করেছিল। জ্যোতির্ময়ী দেবীর পাশাপাশি রানী সত্যভামা দেবী যখন সন্ন্যাসী মেজো কুমার বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন স্ত্রী বিভাবতী তখন পর্যন্ত সন্ন্যাসীর কোনো খোঁজখবর নেননি। জ্যোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীর কাছ থেকে তার গুরুর নাম জেনেছিলেন, ধরম দাস। ধরম দাসকে খুঁজে সন্ন্যাসীর ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তারা সন্ন্যাসীর পক্ষেই কথা বলেছিলেন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে ধরম দাস দ্রুতই ঢাকা ত্যাগ করে। তবে পরবর্তীতে ধরম দাস ও তার দলের অন্য সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে সবিস্তারে তাদের সাক্ষ্য পাওয়া গিয়েছিল। সত্যভামা দেবী মেজো কুমারের স্ত্রী বিভাবতীকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রানী বিভাবতী সে চিঠি গ্রহণ করেননি এবং নিজে সন্ন্যাসীর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি। সত্যভামা দেবী মারা গেলে সন্ন্যাসী ১৯২৪ সালে কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার সঙ্গে জ্যোতির্ময়ী দেবীও থাকতেন। কলকাতায় এসে বড় রানী সূর্যবালা দেবীর সঙ্গে সন্ন্যাসীর দেখা হয় এবং বড় রানীও তাকে মেজো কুমার বলে গ্রহণ করে নেন। নিজ স্ত্রী বিভাবতী, তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ও হাতেগোনা কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী ছাড়া সবাই সন্ন্যাসীকে মেজো কুমার বলে গ্রহণ করেছিল। ১৯২৬ সালের ৮ ডিসেম্বর সন্ন্যাসী বোর্ড অব রেভিনিউর কাছে দাবি করেন, তার পরিচয় তদন্ত করা হোক। বোর্ড সে দাবি অগ্রাহ্য করেছিল। ১৯২৯ সালে সন্ন্যাসী ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল নিজেকে মৃত রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ বলে দাবি করে ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারি চেয়ে আদালতে মামলা করেন। প্রতিবাদী ছিলেন রানী বিভাবতী, তবে কলকাঠি নেড়েছিলেন তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ও আশু ডাক্তার। চার বছর পর এ ঐতিহাসিক মামলাটির শুনানি শুরু হয়। দেশের বাইরে বিলাতে এর কমিশন গঠন করা হয়েছিল। আদালতে মোট ১০৬৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছিল, এর মাঝে ৯৬৭ জন সন্ন্যাসীকে মেজো কুমার বলে সাক্ষী দিয়েছিল। কুমারের নিকটাত্দীয়দের প্রায় সবাই সাক্ষী দেন তিনিই প্রয়াত মেজো কুমার এমনকি মেজো রানী বিভাবতীর আত্দীয়দের অনেকেই সন্ন্যাসীর পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন। প্রতিবাদিনীর ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই আর আদালতে টিকতে পারছিল না। মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের উচ্চতা, জামার মাপ, জুতার মাপ, চুলের রং, শরীরের বিশেষ চিহ্নগুলোর সবই সন্ন্যাসী মেজো কুমার বলে প্রতীয়মান হন। বিশেষ করে ডাক্তাররা মেজো কুমারের শরীরে যে কয়েকটা বিশেষ জন্মগত দাগ, তিল, ফোঁড়ার দাগ ও দুর্ঘটনার ফলে আঘাতের চিহ্ন রয়েছিল তার সবগুলোই হুবহু খুঁজে পান। প্রতিবাদিনীর ব্যারিস্টারের কোনো যুক্তিতর্কই আদালতে টিকল না। আদালত সবশেষে সন্ন্যাসীর বক্তব্য চাইলেন। সন্ন্যাসী ধীরে ধরে বলে গেলেন অভূতপূর্ব, অবিশ্বাস্য এবং রোমাঞ্চকর সে ঘটনা_ দার্জিলিংয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর শেষ যা মনে আছে তিনি বলতে লাগলেন, আমার পেট ফাঁপত। আশু ডাক্তার সেদিন ওষধু দেওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পর দিন আবারও যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছিলাম। আশু ডাক্তার কাচের গ্লাসে আমাকে কী একটা ওষুধ খেতে দিয়েছিলেন। সেটা খাওয়ার পর বুকজ্বালা করতে লাগল, বমি হলো, সারা শরীর ছটফট করতে লাগল। পর দিন শরীর আরও খারাপের দিকে গেল, আমি যে দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম সেটা খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছিলাম। একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ি যখন চোখ মেলি দেখি পাশে চারজন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আমি কোথায়? তারা ইশারায় ও মৃদু স্বরে আমাকে হিন্দিতে জবাব দিয়েছিলেন কথা না বলতে। সুস্থ হয়ে উঠলে আমি সন্ন্যাসীদের সঙ্গে হেঁটে ও ট্রেনে চেপে বহু দেশ-বিদেশ ঘুরতে থাকি। আমি মাঝেমধ্যেই আমার গুরুকে জিজ্ঞেস করতাম, বাড়ি ফেরার কথা বলতাম, গুরু জবাব দিতেন, সময় হলেই যাবি। আমি এভাবে বহু বছর এদেশ-ওদেশ বেড়িয়ে নেপালে গিয়ে পেঁৗছলাম। সেখান থেকে তিব্বত। আবার নেপালে ফিরে আসার পথে গুরু বললেন, তোর বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। আমি গৌহাটি থেকে ট্রেনে চেপে ফুলছড়ি হয়ে ঢাকা আসি। বাকল্যান্ড বাঁধের কাছে আমি বসে থাকতাম। অনেকেই আমাকে ভাওয়াল রাজা বলে ভিড় জমাত। আমি জয়দেবপুরে হাতির পিঠে চেপে ফিরে আসি।... সন্ন্যাসীর বিবরণের পাশাপাশি পারিবারিক অতীত ঘটনা সম্বন্ধীয় নানা জেরা করা হয়, আদালতে তিনি সবগুলো প্রশ্নেরই ঠিক জবাব দিতে পেরেছিলেন। ছোটবেলার নানা ঘটনা, পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানের বিবরণ কিছুই বাদ যায়নি। মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায় সন্ন্যাসী বেশে দীর্ঘর্ ১২ বছর পর ফিরে এসে আদালতে যখন নিজ অতীতের নিখুঁত বর্ণনা দিলেন, তখন আর কারোই বুঝতে বাকি থাকল না তিনি নিঃসন্দেহে ঠক বা প্রতারক নন। এবার আদালত সন্ন্যাসী গুরু ও তার দলের লোকদের কাছে মূল ঘটনাটি শুনতে চান। সন্ন্যাসী গুরু ধরম দাস নাগা তার সাক্ষ্যতে বলেন- আমরা মোট চারজন সন্ন্যাসী ঘুরতে ঘুরতে দার্জিলিং এসে পড়েছিলাম। রাতের প্রথম প্রহরে আমরা যখন ধর্মালোচনা করছিলাম তখন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে, আমরা গুহা থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম একদল লোক হরিবোল ধ্বনি নিতে শ্মশানে জমায়েত হয়েছে। কিছুক্ষণ বাদে আমিও লণ্ঠন নিয়ে গুহা ছেড়ে বাইরে আসি এবং শ্মশানের কোথাও থেকে মানুষের কাতরানোর আওয়াজ শুনতে পাই । কাতরানোর আওয়াজ খুঁজে পেয়ে দেখি এক লোক খাটিয়ার ওপর শুয়ে আছে। সে জ্বরে এবং ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। গুরু লোকটার নাকে হাত দিয়ে বলেন, লোকটা বেঁচে আছে, একে ধরো, গুহায় নিয়ে চলো। পাহাড়ের নিচ দিকে একটা ঘর ছিল, বৃষ্টি ক্রমেই বাড়ছে বলে আমরা তাকে নিয়ে ওই ঘরটার কাছে নিয়ে যাই। ঘরে তালা লাগানো ছিল, কিন্তু কাউকে না দেখে লোকনাথ বাবা বললেন, তালা ভেঙে ফেল। পর দিন লোকটির জ্ঞান ফিরে এলেও সে কোনো পরিচয় দিতে পারছিল না। পুরো ঘটনাটি অন্য দুই সন্ন্যাসী আদালতে আলাদাভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এতে দেখা যায়, ধরম দাস নাগার সাক্ষ্যের সঙ্গে অন্যদের সাক্ষ্যেরও মিল আছে। ১৯৩৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিবাদী পক্ষের ব্যারিস্টার এ এন চৌধুরী শুনানি শুরু করে শেষ করেন ৩১ মার্চ। আর সেদিনই বাদীপক্ষের ব্যারিস্টার বি এস চ্যাটার্জি শুনানি শুরু করেন। এরপর ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট বিচারপতি পান্না লাল বসু ভাওয়াল রাজবাড়ির সন্ন্যাসী মামলাটির ঐতিহাসিক রায় দেন। দীর্ঘ রায়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তিনি বলেন, বাদীকে শনাক্ত করার জন্য প্রমাণ ছিল তার দেহের কতগুলো চিহ্ন, যেগুলো অঙ্কের মতোই নির্ভুলভাবে প্রমাণিত। দুজন ব্যক্তির একই রকম চেহারা থাকতে পারে, কিন্তু দুজনের দেহে একই দাগ হুবহু মিলে যেতে পারে না। আমি বিচারে এই সাব্যস্ত করছি যে, বাদীই ভাওয়ালের মৃত রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র রমেন্দ্রনারায়ণ রায়। মামলার রায়ের সঙ্গে সঙ্গেই আদালত প্রাঙ্গণে সমবেত জনতা ঢাকার আরমানিটোলা বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। সেই বাড়িতে সন্ন্যাসী ছাড়াও জ্যোতির্ময়ী দেবী তখন ছিলেন। ঢাকার পথে ভাওয়াল রাজার জয়ধ্বনিতে শোভাযাত্রা হয়। পরে রানী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতার হাইকোর্টে ১৯৪০ সালে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। সেটাও ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই আদালত খারিজ করে দেন এবং সন্ন্যাসীকে মেজো কুমার বলে ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে আদালত ভাওয়াল এস্টেটের এক-তৃতীয়াংশ আইন মতে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার স্ত্রী বিভাবতী ও অন্য ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। কিন্তু তারা সন্ন্যাসীকে মেজো কুমার বলে মেনে নেননি। পরবর্তীতে ভাওয়াল সন্ন্যাসীখ্যাত মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ ধরাসুন্দরী নামক এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। ভাওয়াল রাজ এস্টেট ফিরে পেয়ে সন্ন্যাসী খুব বেশিদিন ভাওয়াল এস্টেট পরিচালনা করতে পারেননি। ১৯৪৬ সালের ৫ আগস্ট তিনি মারা যান। সন্ন্যাসী রাজার স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তার রহস্যময় মৃত্যু ও প্রত্যাবর্তন এ দেশে শেষ রাজার ইতিকাব্যকে করেছে রোমাঞ্চকর।
 
 

No comments

বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ. Powered by Blogger.